রসায়নের জনক জাবির ইবনে হাইয়ান কীভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রসায়ন শাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, সে সম্পর্কে জানুন। এই নিবন্ধে তাঁর অবদান, আবিষ্কার এবং রসায়ন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

রসায়ন: প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত

রসায়ন আমাদের চারপাশের পদার্থের গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং এদের মধ্যেকার রাসায়নিক বিক্রিয়ার বিজ্ঞান। হাজার বছর ধরে মানুষ রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলির সাথে অবচেতনভাবে জড়িত ছিল। অগ্নি জ্বালানো, ধাতু গলানো, রঞ্জন প্রস্তুতকরণ ইত্যাদি কাজের মধ্যে রয়েছে রসায়নের প্রাথমিক ব্যবহার। তবে, একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসাবে রসায়নের গোড়াপত্তন ঘটে মধ্যযুগে, আর এই ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্‍ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ানের অবদান সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

রসায়নের জনক: জাবির ইবনে হাইয়ান কে?

জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২১-৮১5 খ্রিস্টাব্দ), যিনি আল-কিমিয়া (কিংবা আলχηিমি) নামেও পরিচিত, একজন বিখ্যাত মুসলিম পলিমথ ছিলেন। তিনি রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ಞান, দর্শন, ঔষধ এবং অন্যান্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তবে, রসায়ন শাস্ত্রের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। তাঁকেই আধুনিক রসায়নের জনক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

জাবির ইবনে হাইয়ানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি

জাবির ইবনে হাইয়ান কেবল তত্ত্বীয় জ্ঞানের উপর নির্ভর করতেন না। বরং, তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম, যিনি রসায়ন গবেষণাগার স্থাপন করেছিলেন। এই গবেষণাগারে তিনি বিভিন্ন পদার্থের উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন এবং তাদের বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেছেন। তিনি পরীক্ষা-নীতির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি পদার্থের পরিমাপের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন।

জাবির ইবনে হাইয়ানের মৌলিক অবদান

রসায়ন শাস্ত্রের ক্ষেত্রে জাবির ইবনে হাইয়ানের অবদান ব্যাপক ও মৌলিক। আসুন, তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান বিস্তারিতভাবে দেখি:

  • তত্ত্বীয় ভিত্তি স্থাপন: রসায়নকে কেবল মন্ত্র-তান্ত্রিক ক্রিয়া বা ধাতু রূপান্তরের (আলকেমি) পদ্ধতি হিসেবে দেখা হতো। জাবির ইবনে হাইয়ান এই ধারণাকে পরিবর্তন করেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে তত্ত্বীয় কাঠামো গড়ে তোলেন। পদার্থের গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং এদের মধ্যেকার রাসায়নিক বিক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিতে তিনি বিভিন্ন তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি দহন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যার জন্য সর্বপ্রথম “গন্ধক তত্ত্ব” প্রদান করেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ধাতুতে দুটি উপাদান থাকে – গন্ধক (sulphur) এবং পারদ (mercury)। ধাতু জ্বালানোর সময় গন্ধক নিঃসৃত হয় এবং ধাতুকে ভস্মায় পরিণত করে।
  • পর্যায় সারণী নির্মাণের পথিকৃৎ: আধুনিক রসায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো পর্যায় সারণী। যদিও জাবির ইবনে হাইয়ান পুরোপুরি পর্যায় সারণী আবিষ্কার করেননি, তিনি এর ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বিভিন্ন ধাতু এবং অধাতুরের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে তাদেরকে শ্রেণীবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এই শ্রেণীবদ্ধকরণ পরবর্তী বিজ্ঞানীদের পর্যায় সারণী আবিষ্কারের পথ সহজ করে।
  • রাসায়নিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন: পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে জাবির ইবনে হাইয়ান নতুন নতুন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি আল-ম্বিক (alembic) নামক পাতন যন্ত্র উদ্ভাবন করেন, যা এখনো আধুনিক রসায়ন গবেষণাগারে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, তিনি ঘনীভবন (condensation) এবং বাষ্পীভবন (evaporation) প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি তৈরি করেন। এই উদ্ভাবনগুলি রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে আরও সহজ ও নিখুঁত করে তোলে।
  • অম্ল-ক্ষার তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা (অব্যাহত): জাবির ইবনে হাইয়ান অম্ল-ক্ষার তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা দেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করেন যে, অম্ল এবং ক্ষারের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটে। এই বিক্রিয়ার ফলে নিরপেক্ষ (neutral) পদার্থের সৃষ্টি হয়। যদিও তাঁর তত্ত্ব সম্পূর্ণ ছিল না, তবুও এটি আধুনিক অম্ল-ক্ষার তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  • ধাতুবিদ্যা (Metallurgy): ধাতু বিশ্লেषण ও পরিশোধনের ক্ষেত্রে জাবির ইবনে হাইয়ানের অবদান অসামান্য। তিনি বিভিন্ন ধাতুর গলনাঙ্ক নির্ণয় করেন এবং ধাতু থেকে মলিনতা দূর করার কৌশল উদ্ভাবন করেন। এছাড়াও, তিনি ইস্পাতের গুণমান উন্নত করার কৌশল আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারগুলি তৎকালীন অস্ত্রশস্ত্র ও ধাতব নির্মাণশিল্পের উন্নয়নে বিশেষ योगदान (যোগदान – yogadan – contribution) রাখে।
  • রাসায়নিক পদার্থ আবিষ্কার: জাবির ইবনে হাইয়ানের সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কারগুলির মধ্যে রয়েছে নাইট্রিক এসিড (nitric acid) এবং সালফিউরিক এসিড (sulfuric acid) আবিষ্কার। এই দুটি শক্তিশালী অম্ল এখনো রাসায়নিক শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, তিনি সাইট্রিক এসিড (citric acid) আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
  • রঞ্জন ও কাগজ উৎপাদন: বস্ত্র রঞ্জন প্রক্রিয়ায় জাবির ইবনে হাইয়ানের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তিনি বিভিন্ন উদ্ভিদ ও খনিজ পদার্থ থেকে নতুন নতুন রঞ্জক আবিষ্কার করেন। এছাড়াও, তিনি রঞ্জন স্থায়ী করার কৌশল উদ্ভাবন করেন। কাগজ উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও তাঁর অবদান রয়েছে। তিনি কাগজের গুণমান উন্নত করার জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের प्रयोग (প্রয়োগ – prayog – application) করেন।
  • রসায়ন বিষয়ক রচনা: জাবির ইবনে হাইয়ান বিষয়ী রসায়ন গ্রন্থাবলীর রচয়িতা ছিলেন। তিনি দু হাজারেরও বেশি রচনা রচনা করেছিলেন, যদিও সবগুলিই বড়ো আকারের নাও হতে পারে। তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “কিতাব আল-خمائر (Kitab al-Kimya)” (“রসায়নের বই”), “কিতাব আল-Զুহারা (Kitab al-Zuharat)” (“ফুলের বই”) ইত্যাদি। এই রচনাসমূহ মধ্যযুগীয় ইউরোপে অনুবাদিত হয়।
https://akhirolellin.com
Do you like আখিরুল ইল্লিন's articles? Follow on social!
People reacted to this story.
Show comments Hide comments
Comments to: রসায়নের বিপ্লব: রসায়নের জনক জাবির ইবনে হাইয়ানের অবদান

Write a response

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.