রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল (Rutherford Atomic Model)

60
0

রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম একটি মাইলফলক। ১৯১১ সালে, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড একটি নতুন পরমাণু মডেলের প্রস্তাব করেন যা পরবর্তীতে রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল হিসেবে পরিচিত হয়। এই মডেলটি পরমাণুর গঠন এবং প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে বদলে দিয়েছে।

পরমাণুর সৌর মডেলের চিত্র। সবুজ বিন্দু দিয়ে ইলেকট্রন এবং লাল বিন্দু দিয়ে নিউক্লিয়াস বোঝানো হয়েছে।পরমাণুর সৌর মডেলের চিত্র। সবুজ বিন্দু দিয়ে ইলেকট্রন এবং লাল বিন্দু দিয়ে নিউক্লিয়াস বোঝানো হয়েছে। ছবিঃ উইকিপিডিয়া

প্রেক্ষাপট (Problem)

পরমাণুর গঠন সম্পর্কে শুরুতেই ভুল ধারণা ছিল। ১৯০৪ সালে জেজে থমসন তার ‘প্লাম পুডিং’ মডেল প্রস্তাব করেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে পরমাণু হলো একটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত পদার্থের মন্ড যার মধ্যে ঋণাত্মক ইলেকট্রনগুলো বিখরিত অবস্থায় আছে। তবে এই মডেলটি পরমাণুর প্রকৃতি এবং এর গঠন সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়।

আকর্ষণ (Agitation)

থমসনের মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড তার বিখ্যাত গোল্ড ফয়েল পরীক্ষাটি করেন। এই পরীক্ষার ফলাফল ছিল আশ্চর্যজনক এবং তা থমসনের মডেলকে ভুল প্রমাণিত করে।

সমাধান (Solution)

রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটি দেখায় যে পরমাণুর কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র, ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস থাকে এবং ইলেকট্রনগুলো এর চারপাশে কক্ষপথে ঘোরে। এই মডেলটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মূলভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

রাদারফোর্ডের গোল্ড ফয়েল পরীক্ষা

১৯০৯ সালে, রাদারফোর্ড এবং তার সহকারী হ্যান্স গেইগার এবং আর্নেস্ট মার্সডেন একটি পরীক্ষা পরিচালনা করেন যা গোল্ড ফয়েল পরীক্ষা নামে পরিচিত। তারা খুব পাতলা সোনার ফয়েলের ওপর আলফা কণার বিম প্রক্ষেপণ করেন। বেশিরভাগ আলফা কণা সরাসরি ফয়েলের মাধ্যমে চলে যায়, তবে কিছু কণা ভিন্নমুখে বিচ্ছুরিত হয় এবং খুব কম কণা সরাসরি প্রতিফলিত হয়। এই পরীক্ষাটি পরমাণুর নতুন মডেল প্রস্তাব করতে সাহায্য করে।

পরীক্ষার পদ্ধতি

রাদারফোর্ড তার পরীক্ষায় অত্যন্ত পাতলা সোনার ফয়েল ব্যবহার করেন। আলফা কণার বিম প্রক্ষেপণের মাধ্যমে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন কিভাবে কণাগুলি ফয়েলের মাধ্যমে অতিক্রম করে এবং তাদের আচরণ কেমন হয়। তিনি একটি ফ্লুরোসেন্ট স্ক্রিন ব্যবহার করেন যা আলফা কণাগুলির বিচ্ছুরণ পর্যবেক্ষণ করতে সহায়তা করে।

পরীক্ষার ফলাফল

  • বেশিরভাগ আলফা কণা সরাসরি চলে যায়: এই পর্যবেক্ষণটি দেখায় যে পরমাণুর অধিকাংশ স্থান শূন্য। এটি প্রমাণ করে যে পরমাণু আসলে একটি কঠিন বস্তু নয়, বরং অধিকাংশ স্থানই শূন্য।
  • কিছু কণা বিচ্ছুরিত হয়: এটি ইঙ্গিত দেয় যে পরমাণুর মধ্যে কিছু ভারী বস্তু আছে যা আলফা কণাগুলিকে বিচ্ছুরিত করে। এর ফলে বোঝা যায় যে পরমাণুর কেন্দ্রে কিছু আছে যা এই বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে।
  • কিছু কণা সরাসরি প্রতিফলিত হয়: এটি দেখায় যে পরমাণুর কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র কিন্তু ভারী ধনাত্মক নিউক্লিয়াস রয়েছে। এই নিউক্লিয়াসের কারণে আলফা কণাগুলি সরাসরি প্রতিফলিত হয়।

রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলের বৈশিষ্ট্য

রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  1. নিউক্লিয়াস: পরমাণুর কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র, ভারী এবং ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস থাকে।
  2. ইলেকট্রন: ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে কক্ষপথে ঘোরে।
  3. শূন্যস্থান: পরমাণুর অধিকাংশ স্থান শূন্য।
  4. নিউক্লিয়াসের আকার: নিউক্লিয়াসের আকার পরমাণুর আকারের তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র।

রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলের গুরুত্ব

রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটি পরমাণুর প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে। এটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এবং এটি পরমাণুর গঠন সম্পর্কে আরও গভীর গবেষণার পথ খুলে দেয়।

রাদারফোর্ড মডেলের সীমাবদ্ধতা

যদিও রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, তবুও এতে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল:

  1. ইলেকট্রনের কক্ষপথ: রাদারফোর্ড মডেলটি ইলেকট্রনের কক্ষপথ সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারে না।
  2. শ্রেণিবিন্যাসের সমস্যা: মডেলটি পরমাণুর শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করতে ব্যর্থ হয়।
  3. উদ্দীপন এবং বিকিরণ: এটি ইলেকট্রনের উদ্দীপন এবং বিকিরণ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেনি।

রাদারফোর্ড মডেলের পরবর্তী উন্নতি

রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটির সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে নিলস বোর ১৯১৩ সালে তার বোর মডেল প্রস্তাব করেন। বোর মডেলটি রাদারফোর্ড মডেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় এবং ইলেকট্রনের কক্ষপথ এবং শক্তিস্তর সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

১. রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল কি? রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটি একটি পরমাণুর কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র, ভারী এবং ধনাত্মক নিউক্লিয়াস এবং এর চারপাশে ইলেকট্রনের কক্ষপথে ঘোরার মডেল।

২. রাদারফোর্ড গোল্ড ফয়েল পরীক্ষার ফলাফল কি ছিল? গোল্ড ফয়েল পরীক্ষায় দেখা যায় যে বেশিরভাগ আলফা কণা সরাসরি ফয়েলের মাধ্যমে চলে যায়, কিছু কণা বিচ্ছুরিত হয় এবং খুব কম কণা প্রতিফলিত হয়। এটি পরমাণুর কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসের উপস্থিতি প্রমাণ করে।

৩. রাদারফোর্ড মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলো কি? রাদারফোর্ড মডেলের সীমাবদ্ধতাগুলো হলো ইলেকট্রনের কক্ষপথ সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করতে না পারা, পরমাণুর শ্রেণিবিন্যাসে সমস্যা, এবং ইলেকট্রনের উদ্দীপন ও বিকিরণ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারা।

৪. রাদারফোর্ড মডেলের উন্নতির জন্য পরবর্তী কোন মডেলটি প্রস্তাব করা হয়? রাদারফোর্ড মডেলের উন্নতির জন্য নিলস বোর ১৯১৩ সালে বোর মডেল প্রস্তাব করেন। বোর মডেলটি ইলেকট্রনের কক্ষপথ এবং শক্তিস্তর সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করে।

উপসংহার

রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলটি পরমাণুর গঠন এবং প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে। এই মডেলটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এবং এটি পরমাণুর গঠন সম্পর্কে আরও গভীর গবেষণার পথ খুলে দিয়েছে। এর সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে পরবর্তীতে নিলস বোরের মডেল প্রস্তাব করা হয়, যা রাদারফোর্ড মডেলের উপর ভিত্তি করে আরও উন্নত তথ্য প্রদান করে।

রসায়ন কি? ইতিহাস, কাজ, জনক ইত্যাদি।

আখিরুল ইল্লিন
WRITTEN BY

আখিরুল ইল্লিন

আমি আখিরুল ইল্লিন, পড়াশোনার পাশাপাশি আমি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। আমি একজন ভয়েস ওভার আর্টিস্ট, ব্লগার এবং গ্রাফিক্স ডিজাইনার। সাহিত্যের প্রতি আমার আগ্রহ আমাকে 'সাহিত্য রস' নামক সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে অনুপ্রাণিত করেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।